×
  • প্রকাশিত : ২০২৩-০৩-০৬
  • ৫৬৭ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ঐতিহাসিক ভাষণে গ্রামীণ সাধারণ মানুষের ভাষা থাকায় এ ভাষণ স্বাধীনতার সংগ্রামের বীজমন্ত্র হয়ে পড়ে। অন্যদিকে এ ভাষণ শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলিলই নয়, জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয় প্রকাশের একটি সম্ভাবনাও তৈরি করে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে এ মন্তব্য করেছেন দেশের সাংস্কৃতিক-নাট্য এবং ভাষা বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, বঙ্গবন্ধু ’৭১-এর ৭ মার্চ যে ভাষণ দিয়েছিলেন ইতিহাসে তার তুলনা খুঁজে পাওয়া যায় না। এই ভাষণে তথাকথিত পরিশীলিত বাচনভঙ্গির চেয়ে গ্রামীণ সাধারণ মানুষের ভাষা থাকায় গোটা দেশের মানুষকে আপ্লুত এবং মুক্তির সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ফলে এই ভাষণ স্বাধীনতার সংগ্রামের বীজমন্ত্র হয়ে পড়ে।
লোক সংস্কৃতি ও পল্লী সাহিত্য গবেষক শামসুজ্জামান খান এ ভাষণ প্রসঙ্গে লিখেছেন, আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ এড্রেস বা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় চার্চিলের ভাষণসহ অন্য কোন ভাষণের সঙ্গে এ ভাষণের তুলনা চলে না, এই দেশের মাটি, মানুষ, নিসর্গ, প্রকৃতি এবং জীবনধারার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এই ভাষণটি মনে হয় যেন বঙ্গবন্ধু জীবনব্যাপী সাধনায় ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে প্রস্তুত করে নিয়েছিলেন। এমন মনে হয় যে, বাঙালির হাজার বছরের দুঃখ-বেদনা, বঞ্চনা এবং ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে থাকার ইতিহাস, কৃষক, কৈবর্ত, উপজাতিদের বিদ্রোহ প্রভৃতির বারুদ ঠাঁসা উপাদানে তাঁর সচেতন এবং অবচেতন মনে এই ভাষণটি তৈরি হয়ে প্রকাশের জন্য উন্মুখ হয়েছিল।
অনেকেই মনে করেন ৭ মার্চ এক অলৌকিক মুহূর্তে সেই ভাষণটি এমন অসাধারণ ভাষা, ভঙ্গি ও আঙ্গিকগত স্বাতন্ত্র্যে বাঙ্গময়তার সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল, যা মনে হয় যেন এক ঐশ্বরিক ক্ষমতার স্পর্শে উচ্চকিত ভাষণ। যে ভাষণ মানুষকে তার মর্মমূল থেকে গভীরভাবে উদ্দীপ্ত এবং জাগ্রত করে তুলেছিল। এতে করে এই ভাষণের পরতে পরতে যুক্ত হয়ে থাকা দ্রোহের বাণী মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে, এমনকি প্রয়োজনে লড়াকু মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকায় উত্তীর্ণ করে তোলে। এই জন্যই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালির স্বাধীনতার বীজমন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের অশেষ প্রেরণা এবং বাঙালির হাজার বছরের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের এক শক্তিশালী হাতিয়ার।
বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে আধুনিক ইতিহাসের একটি অনন্য রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনা এবং আন্দোলনের দলিল হিসেবে অভিহিত করে বলেন, এতে ভাষাগত যে উৎকর্ষ আছে তা রীতিমত বিস্ময়কর। তিনি বলেন, কোলকাতা কেন্দ্রিক ভাষার বাক্য প্রকরণ রীতির বিপরীতে পদ্মাপাড়ের ভাষা ও বাক্য প্রকরণ রীতির উন্মেষ ঘটেছিল এই ভাষণের মধ্যে। এতে করে যে ঘটনাটি ঘটেছে তা হচ্ছে- বাংলা ভাষা একটি সুনির্দিষ্ট দিকে বাঁক নেয়, যা পোশাকী ভাষার বিপরীতে ভাটি বাংলার মৃত্তিকা সংলগ্ন ভাষা। এ কারণে এটি শুধু রাজনৈতিক দলিল নয়, একটি সাংস্কৃতিক পরিচয় বিধানের সম্ভাবনা তৈরি করেছিল এই ভাষণ।
তিনি বলেন, ভাটি বাংলার খর¯্রােতা নদী এবং বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ধ্বনি এবং ভঙ্গি এই ভাষণের মধ্য দিয়ে জাতির সামনে উপস্থাপিত হয়েছিল। যার কারণে সারাদেশের মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মত এই ভাষণ শুনেছে- যার জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে যুগ যুগ ধরে। সেদিনের ভাষণ পাঠ করলে বিভিন্ন ভাবেই স্বাধীনতার মর্মার্থ অনুধাবন করা যায়। ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে শব্দগুলো ব্যবহার করেছিলেন সেগুলো ছিল একটি চূড়ান্ত লড়াইয়ের নির্দেশ।
ভাষণে সবকিছুকে ছাড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এর পরেই অকুতোভয় বাঙালি এবং সর্বস্তরের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তির চূড়ান্ত লড়াইয়ে। ঐক্যবদ্ধ মানুষের শক্তি কত যে প্রচ- হতে পারে তা দখলদার বাহিনী তো বটেই সারাবিশ্বের মানুষও দেখেছে অবাক বিষ্ময়ে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ রণকৌশলের দিক দিয়ে অসাধারণত্ব, আবেগ আর স্বতঃস্ফুর্ততার পরিচায়ক। যে ভাষায় তিনি কথা বলতেন, সেই ভাষায় তিনি বক্তব্য দিয়েছেন। এ ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় বাংলাদেশের মানুষের গৌরব সম্মান আরেকবার আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
#
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat